ডেস্ক নিউজ:

কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেয়া ত্রাণ বিতরণ করে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসি)। প্রায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব পান কক্সবাজার ইউনিট কার্যালয়ের প্রকল্প সমন্বয়ক সেলিম আহমেদ। সেলিম আহমেদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাণ বিতরণে হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। তার বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে বিডিআরসি’র কার্যক্রমের উপর নিরীহ দুস্থ মানুষের আস্তা উঠে যাচ্ছে। আর ত্রাণ লুট করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন সেলিম আহমেদ। ত্রাণ বিতরণের সকল কার্যক্রমে নিয়োজিত যুব রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের দেওয়া তথ্যে দূর্নীতির ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসছে।

প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর সেই দেশের সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের কারণে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা নয়াপাড়া এলাকায় আশ্রয় নেয়। মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সামগ্রি ‘ফুড ফ্রুটিলা’ পাঠায় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেই ফুড ফ্রুটিলা বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে। ওই ফুড ফ্রুটিলা প্রোগ্রামে ৪৭৫ টন খাদ্য সামগ্রি ছিল। প্রতিটি প্যাকেটে চাল, ডাল, তেলসহ ৩৫ ধরণের খাদ্য সামগ্রি ছিল। সেগুলোকে ১৫ হাজার ২৫০ টি প্যাকেট করা হয়। পরে প্রতি পরিবারে একটি করে প্যাকেট বিতরণ করা হয়। প্যাকেট বিতরণের আগে তালিকা করার সময় প্রতি পরিবারে একটি করে কার্ড দেওয়া হয়। ওই সময় প্রতিকার্ডে উপকারভোগির কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণের জন্য দেওয়া হলেও প্যাকেট প্রতি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে আদায় করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে খোদ জেলা ইউনিটের ম্যানেজিং কমিটি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম দেখাশুনা করেন কক্সবাজার জেলা ইউনিটের ডাইজেস্টার রেসপন্স প্রোগ্রামের সমন্বয়ক সেলিম আহমেদ। সেলিম আহমেদ বিনামূল্যের ফুড ফ্রুটিলা প্রোগ্রামে ১৫২৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে ১ কোটি সাড়ে ৫২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকার ভাগ সরাসরি বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের পরিচালক নাজমুল আজম খানের নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। একারণে ওই দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার আসেনি।

সূত্রমতে, এমআরআরও প্রকল্পে কুতুপালং ক্যাম্পের নিবন্ধিত ৬ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রি দেওয়া হয়। এই ননফুড প্রকল্পের ৬ হাজার ৫০০ উপকারভোগি পরিবারের কাছ থেকেও আদায় করা হয়েছে ১ হাজার টাকা করে। সেখানে সেলিম আহমেদ দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ৬৫ লাখ টাকা। এই প্রকল্পটি বর্তমানেও চলমান।

পপুলেশন মুভমেন্ট প্রোগ্রামে ৫হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে খাদ্য সামগ্রির প্যাকেট দেওয়া হয়। সেখানে প্রতি প্যাকেটে সাড়ে ৬ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রি ছিল। ওই প্রকল্পেও প্যাকেট প্রতি ১হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন সেলিম আহমেদ। পপুলেশন মুভমেন্ট প্রোগ্রাম থেকে সেলিম সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। যদিও এসব প্রকল্পের ত্রান গুলো বিনামূল্যে দেওয়ার কথা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসি) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে কক্সবাজার ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে একটি ইউনিটে ৫ বছরের বেশি সময় থাকার নিয়ম না থাকলেও ২৭ বছর ধরে বহাল রয়েছেন সেলিম আহমেদ। দীর্ঘ এই সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন তিনি। তাকে সরাসরি সহযোগিতা করেন সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের পরিচালক নাজমুল আজম খান। একারণে বহুবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার আসেনি।

সূত্রে জানা গেছে, ফুড ফ্রুটিলার ত্রাণ বিতরণের সমন্বয়ক ছিল বিডিআরসির কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ। ওই ত্রাণ গুলো বিতরণে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানে ত্রাণ বিতরণে ভুয়া খরচ বিল করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। বাকি ১৫ লাখ টাকা ভুয়া বিল করে হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারা করে সেলিম সিন্ডিকেট। আর তাঁর এই দুর্নীতিতে সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছে বিডিআরসির সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের পরিচালক নাজমুল আজম খান।

জানা গেছে, ফুড ফ্রুটিলার ত্রাণ বিতরণের সময় বিডিআরসির কর্মকর্তারা কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প যাতায়াতের জন্য দুইটি মাইক্রোবাস ভাড়া নেয়। প্রতিটি মাইক্রোবাস দৈনিক ৪ হাজার টাকা করে ২৭ দিনে দুই মাইক্রোবাসের বিল আসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। লোডিং খরচ ধরা হয়েছে প্রতি টন ৭০ টাকা করে ৩৩ হাজার ২৫০ টাকা। আনলোডিং খরচ ধরা হয়েছে টন প্রতি ৮০ টাকা করে ২৮ হাজার টাকা। প্যাকেজিং মজুরি প্রতি প্যাকেট ১৪ টাকা করে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ট্রাক ভাড়া প্রতি টন ৩০০ টাকা করে ২৭ দিনে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। প্রতি বস্তা ৯ টাকা করে ৪১ হাজার টাকা। অফিসার ভাতা জন প্রতি দৈনিক ১ হাজার টাকা করে চারজনের ভাতা ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। আরসিওয়াই ভাতা ২ লাখ টাকা। পলিথিন বিল ৩০ হাজার টাকা। বিবিধ খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে টাকা আত্মসাতের জন্য বিল করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা।

সূত্রমতে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মিয়ানমার রিফৌজি রিলিফ(এমআরআরও) প্রকল্পের নন ফুড সামগ্রী বিতরণেও ব্যাপক দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে সেলিম আহমেদ ও নাজমুল আলম খাঁন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

এই প্রোগ্রামে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নন ফুড সামগ্রীর মধ্যে, সাবান, মশারী, তৈল, কেরোসিন, বালতি, কোকারীজ সামগ্রী এবং নারীদের অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাইজিন কিডস ইত্যাদি বিতরণ করা হয়।

জানা যায়, বিগত ৪ বছর পূর্বে এ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকার সুবাধে যোগদানের প্রথম বছর থেকেই শুরু হয় সেলিমের দূর্নীতি। নন ফুড সামগ্রীর অর্ধেকেরও বেশি ত্রাণ দালালের মাধ্যমে বাহিরে বিক্রয় করে অবশিষ্ট মালামাল রোহিঙ্গাদের মাঝে নামে মাত্র বিতরণ করে আসছে। এতে ক্রমান্বয়ে পকেট ভারী হয়ে উঠেছে আর বঞ্চিত হচ্ছে মিয়ানমার সরকারের দমন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা। সেলিম আহমেদ যোগদানের প্রথম বছরেই এমআরআরও প্রকল্পে ভয়াবহ দূর্নীতি শুরু করলে সেসময় প্রকল্পটিতে কর্মরত ব্যক্তিরা তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন শুরু করেন। সেলিম আহমেদ বর্তমানে বর্তমানে এমআরআরও প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে রয়েছেন। তার দূর্নীতির বিরুদ্ধে সদর দপ্তরেও লিখিত অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, হাইজিন কিড্স সামগ্রির ত্রাণ বিতরণের জন্য উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের জন্য ৩০০ কার্ড বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ওই কার্ডের বিপরীতে সেখানে আরসিওয়াই কর্মী দিয়ে তালিকাও করা হয়। কিন্তু একদিন পর নিজস্ব লোক দিয়ে টাকার বিনিময়ে কার্ড গুলো অন্য রোহিঙ্গাদের কাছে বিতরণ করে। এতে অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয় বিপুল পরিমাণ টাকা।

জানা গেছে, ওই কার্ড অনুযায়ী বিতরণের দিন আরসিওয়াই কর্মীরা কুতুপালং ক্যাম্পে যায়। কিন্তু সকালে তাদের কাছ থেকে ক্যাম্পের বাইরে স্বাক্ষর নিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তাদেরকে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। একইভাবে গত ৫ জুলাইও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একই ঘটনা ঘটান সেলিম আহমেদ।

সূত্রমতে, টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় ফুড প্যাকেজ বিতরণের দায়িত্ব পায় আরসিওয়াই কর্মীরা। গত ১৮ মে সেই ফুড প্যাকেজ বিতরণ করার জন্য যায় আরসিওয়াই কর্মীরা। ওই সময় কৌশলে সন্ত্রাসী ভাড়া করে সেলিম আহমেদ তাদের উপর হামলা করে বিতরণ বানচালের চেষ্টা করে। এভাবেই ফুড প্যাকেজের ১২’শ কার্ড লুপাট করেন সেলিম আহমেদ।

এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন কক্সবাজার যুব রেডক্রিসেন্ট এর যুব প্রধান মোহাম্মদ হোসাইন মাসুম সহ অন্যান্যরা। তারা বলেন, তাদেরকে বিতরণের জন্য নিয়েও গেলেও মূলত স্বাক্ষর নিয়ে তাড়িয়ে দেন সেলিম আহমেদ। পরে ওই সেলিম আহমেদ সেগুলো প্রকৃত উপকারভোগিদের দেয় না।

এবিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত সেলিম আহমেদ জানান, এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এধরণের কোন অনৈতিক কাজের সাথে তিনি জড়িত নয় বলে দাবী করেন।

ব্যাপারে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কক্সবাজার ইউনিটের নির্বাহী কমিটির জেনারেল সেক্রেটারী আবু হেনা মোস্তাফা কামাল’র কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্প্রতি জানতে পেরেছি ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক দূর্নীতির বিষয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সদর দপ্তর তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তাছাড়া বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কক্সবাজার জেলা ইউনিটের চেয়ারম্যার ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, ভাইচ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, সেক্রেটারী আবুহেনা মোস্তফা কামাল চৌধুরী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত ১৩ জুন কেন্দ্রিয় সদর দপ্তরের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও দূর্নীতিবাজ ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিহীত ব্যবস্থা নিতে সদর দপ্তরেও যথাযত অভিযোগ তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কক্সবাজার ইউনিট ও যুব রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তারা।

এদিকে সংবাদ মাধ্যমে দূর্নীতির তথ্য ভিত্তিক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় নাজমুল-সেলিম সিন্ডিকেট নিজেদের রক্ষায় উঠে পড়ে লেগেছে বলেও বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে।

 

–দৈনিক সকালের কক্সবাজার